আমাদের গ্রামের নামটা ছিল অনেক সুন্দর। সদানন্দপুর। আর আমার একটা ভাই ছিল। ওর নাম ছিল পল্টু। ও ছিল আমার চার বছরের বড়। আমাদের গ্রামের পাশেই ছিল রেলস্টেশন। ওখানে একটু পর পর ট্রেন এসে থামতো। আমার ভাইয়াটা ছিল চঞ্চল আর দুরন্ত। আর আমি ছিলাম ভাইয়ার ভক্ত। স্টেশনে ট্রেন এসে থামতো আর ভাইয়া দেঁৗড়ে যেত স্টেশনে। তার পিছনে হাফাতে হাফাতে আমিও। তারপর আমাদের পিছনে ফেলে ট্রেনও চলে যেতো। নীরব হয়ে যেত স্টেশন। আমি আর ভাইয়া তখন ফাঁকা রেল লাইন ধরে হাঁটতাম। ভাইয়াকে অনেক গম্ভীর দেখাতো। গম্ভীরভাবেই ও আমাকে প্রশ্ন করতো, অন্তু বড় হয়ে আমি কি হবো জানিস?
আমি বলতাম, কি হবে তুমি?
ও বলতো, ট্রেনের ড্রাইভার হবো। ট্রেন চালাবো। ট্রেন চালিয়ে অনেক দুরে যাবো। তোকে, মাকে আর বাবাকেও নিয়ে যাবো। তবে তোদের কাছ থেকে কোন ভাড়া নেবনা। তোরা মাগনা।
অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলতাম, তুমি কবে বড় হবে ভাইয়া?
ভাইয়া একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলতো, হবো। তুই দেখিস ঠিকই একদিন বড় হয়ে যাবো।
ভাইয়া একদিন বড় হবে জেনে আমি মনে মনে খুশি হতাম। আমিও খুব চাইতাম ভাইয়া তাড়াতাড়ি বড় হোক। অনেক টাকা কামাই করুক। আমাদের খুব টাকার দরকার ছিল। বাবা একা পারতেন না। কিছুদিন হলো বাবার মাথায় একটা রোগ ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন মাইগ্রেন। চিকিৎসা করালে সেরে যাবে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসা করানোর টাকা নেই। শুধু চিকিৎসা নয়, আমাদের আরো অনেক কিছু করারই টাকা নেই। রাতে বাবা প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ছটফট করেন। চিৎকার করেন। মা বাবার পাশে বসে চোখের জল ফেলেন। আমি আর ভাইয়া নীরব থাকি। আমি জানি ভাইয়া মনে মনে আল্লাহকে ডাকে। আমিও ডাকি।
মাঝে মাঝে আমি আর ভাইয়া ট্রেন লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুরে চলে যেতাম। যেখানে আকাশ হামাগুড়ি দিয়ে মাটিকে ছুঁয়ে ফেলেছে, ততদূরে।
আমাদের গ্রামটি ছিল সুন্দর। আর বিকেলগুলো ছিল আরো সুন্দর। কোন কোন বিকেল ছিল কাঁঠালের রোয়ার মত হলদে। আর ভাইয়ার একটা লাল রংয়ের ঘুড়ি ছিল। ওটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। অন্য সবার ঘুড়ির চেয়ে ভাইয়ার ঘুড়িটা ছিল আলাদা। সব ঘুড়ি ছাড়িয়ে আমাদের ঘুড়িটা পেঁৗছে যেত আকাশের কোলে। ভাইয়া ঘুড়ির সুতার সঙ্গে চিঠি পাঠাতো। বাতাসের টানে সেই চিঠি চলে যেত আকাশের কাছে।
আমি ভাইয়াকে বলতাম, ভাইয়া চিঠিটা কে পড়বে?
ভাইয়া গম্ভীর হয়ে বলতো, আল্লাহ পড়বে। আল্লাহকে বলেছি জুট মিলটা যেন বন্ধ না হয়। বাবার চাকরিটা যেন না যায়।
আমাদের গ্রামের অদূরেই ছিল সিরাজগঞ্জ সরকারী জুটমিল। বাবা ওখানেই চাকরি করতেন। বাবাকে আমরা ভীষণ ভয় পেতাম। জুটমিল বন্ধ হওয়ার আগের কয়েকটি দিন বাবা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন। মাঝে মধ্যেই কাজে যেতেন না। বাড়িতেই থাকতেন সারাদিন। অকারণেই আমাদের বকাঝকা করতেন। সেই দিনগুলো ছিল ভীষণ রকম বাজে আর কষ্টের। সেই দিনগুলো ছিল ঘুড়ি না ওড়ানোর দিন। সেই দিনগুলো ছিল স্টেশনে না যাওয়ার দিন। আর সেই দিনগুলো ছিল আমার আর ভাইয়ার স্কুল ফাঁকি না দিতে পারার দিন। দিনগুলো ছিল নিমফলের মত তেতো আর বিশ্রী।
আবার কোন কোন রাত আমার আর ভাইয়ার কাছে হয়ে উঠতো মোহনীয়। আমাদের ছিল একটি মাত্র ঘর। তার মাঝ খানে ভাগ করা। একভাগে মা আর বাবা থাকতেন। অন্য ভাগে আমি আর ভাইয়া। রাতে বাবা মাইগ্রেনের ব্যথায় চিৎকার করতেন। আমরা তখন ভয়ে তটস্থ থাকতাম। রাত একটু বেশি হলে বাবার ব্যথা কমে যেত। তখন তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেন। ঘুমালে বাবার নাক ডাকতো। রাতে বাবার নাক ডাকার জন্য অপেক্ষা করতাম আমি আর ভাইয়া।
বাবা নাক ডাকা শুরু করলেই রাতগুলো আমাদের কাছে হয়ে উঠতো আরব্য রজনী। বইটই বন্ধ করে ভাইয়া বসে যেত ঘুড়ি বানাতে। আমি তখন মহানন্দে এটা ওটা এগিয়ে দিতাম। মাথা ব্যথা কমে বাবা ঘুমিয়ে পড়লেই আমাদের মুখে হাসি ফুটতো। ভাইয়া আর আমি দরজার শিকল তুলে আস্তে করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতাম। স্টেশনে একটু ঢু মেরে আবার ফিরে আসতাম বাড়িতে। মা টের পেতেন সবই। কিন্তু বাবাকে কিছুই বলতেন না। সকালে নিচু স্বরে আমাদের একটু বকাঝকা করে রেখে দিতেন। মাকে আমরা খুব ভালবাসতাম।
সেই দিনগুলো একটি একটি করে শেষ হচ্ছিল। সেই রাতগুলোও একটি একটি করে ফুরিয়ে যাচ্ছিল। আর দিনগুলোর মত করে, রাতগুলোর মত করে ভাইয়ার ম্যাট্রিক পরীক্ষাটাও একসময় শেষ হয়ে গেল। তারপর ভাইয়া অনেক ভাল রেজাল্ট করলো। সেদিন বাবাকে অনেক খুশি হতে দেখেছিলাম। সেদিন আমরা সারা বিকাল ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম। বাবা কিছুই বলেননি। সেদিন বাবাকে খুব বন্ধু বন্ধু মনে হয়েছিল আমার কাছে।
তারপর ভাইয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিল। আমাকে ডেকে চুপিচুপি বলেছিল, অন্তু আমি বড় হয়ে গেছিরে। আমি এখন কলেজে পড়ি।
ভাইয়ার কথায় খুশিতে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলাম, তুমি কি এখন তাহলে ট্রেন চালাতে পারবা ভাইয়া? তুমি কি এখন অনেক টাকা কামাই করতে পারবা?
সেদিন ভাইয়াও কেঁদেছিল, মাও কেঁদেছিলেন। সেদিন আমরা সবাই কেঁদেছিলাম। সেদিন ছিল আমাদের কান্নার দিন। আমাদের চোখের জলের দিন। সেদিন জুট মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন বাবা চাকরি হারিয়েছিলেন।
তারপর এক বিকেলে ভাইয়া কলেজের হস্টেলে থাকার জন্য বাড়ি ছেড়েছিল। আমি খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তখন কিছুই ভাল লাগতোনা। সদানন্দপুর গ্রামকে, গ্রামের বিকালগুলোকে, পাখি, ফুল, নদী, ঘাস আর স্টেশনকে আমার কাছে অসুন্দর লাগতো। আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করতাম। বাবাও উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে দুই তিন দিন নিরুদ্দেশ থাকতেন। আমি আর মা তখন কাঁদতাম। প্রায়ই আমরা না খেয়ে থাকতাম। তারপর আবার বাবা ফিরে আসতেন। বাবা ফিরে আসতেন, কিন্তু আমাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হতনা। রাতে বাবা মাইগ্রেনের ব্যথায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তেন।
আমি প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটাতাম। বাবার মাথা ব্যথার চিৎকারের জন্য নয়, ক্ষিধায়। আমরা মাঝে মাঝেই রাতে না খেয়ে ঘুমাতাম।
এরপরের কয়েকটি দিন আমরা মাছের মত খাবি খেতে থাকলাম। মৃতপ্রায় মাছের মত ভেসে উঠলাম। আমার লেখাপড়া বন্ধ হলো। ভাইয়া লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে যোগ দিল। আমার শিক্ষানুরাগী বাবার তাতে কোন ভাবান্তর হলোনা। সব মেনে নিলেন তিনি। তারপর চৈত্রের এক বিকেলে ভাইয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক মেয়েকে বউ করে বাড়িতে নিয়ে এল। বাবা তাও মেনে নিলেন।
ভাইয়া ঘোষণা দিল, কারো কোন কথা বলা চলবে না। আমি কোন অন্যায় করিনি। একটি মেয়েকে বিয়ে করে যৌতুকের হাত থেকে বাঁচিয়েছি।
আমরা কেউ কোন কথা বললামও না। বাবার কোন কিছু বলার ক্ষমতা তার চাকরি হারানোর সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তাছাড়া তখন ভাইয়ার টাকায় সংসার চলে। আমরা একটু হলেও ভাল ছিলাম। তাই তাকে কিছু বলা শোভাও পেতনা। অন্তত আমার এরকমই মনে হয়েছিল। ভাইয়া নতুন বউ নিয়ে ঘরে উঠলো। তখনো আমাদের বাড়িতে বাড়তি কোন ঘর না থাকায় আমার স্থান হলো বাবা মার ঘরের মেঝেতে। বাবা রাতে মাথা ব্যথায় চিৎকার চেঁচামেচি করতেন, তাতে আমার কোন সমস্যা হতনা। আমরা তখন সবাই খেয়ে ঘুমাতাম। তারপরও আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। গভীর রাতে ভাইয়া আর ভাবী ঝগড়া করতো। ঝগড়ার বিষয় আমি ধরতে পারতাম না। আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
এক সকালে ভাইয়া নিচু স্বরে মাকে বলছিল, বাবাকে কিছুদিন মিলের কাছাকাছি শ্রমিকদের যে মেস আছে ওখানে শুধু রাতটা থাকতে বল। ওখানে তো এখনও অনেকেই থাকে। আমি টাকা যা লাগে দেব। আগামী মাসে আমি লায়লাকে নিয়ে শহরে চলে যাব, তখন না হয় বাবা ফিরে আসবে।
ভাইয়ার এমন কথায় আমার বুকটা ভেঙ্গে গিয়েছিল সেই সকালে। সারাদিন আমার মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। আমার মনে হয়েছিল বাবাকে আর মাকে নিয়ে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে ভাইয়া থাকবেনা ভাবী থাকবেনা।
আমার অভিমানী বাবা একেবারেই চলে গেলেন। রাতেও এলেন না, দিনেও এলেন না। ভাইয়া-ভাবীর ঝগড়া বন্ধ হয়ে গেল। মা গভীর রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। মা কাঁদতেন আর আমি ভয় পেতাম। যদি কান্নার শব্দে পাশের রুমে ভাবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়!
আমার সেই দিনগুলো ছিল কালনাগীনি সাপের মত। কালো, পিচ্ছিল আর লম্বা। ভাইয়াকে মনে হতো কোন এক সিনেমার ভিলেইন আর ভাবীকে মনে হতো ঘসেটি বেগম।
আমি আবার পড়ালেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমার কিছুই ভাল লাগতোনা। আমি বাবার জন্য তিন বেলা খাবার নিয়ে যেতাম এবং সারাদিন তার কাছেই থাকতাম। রাতেও থাকতে চাইতাম কিন্তু বাবা রাখতেন না। আমিও জোড় করতাম না। মায়ের জন্য আমার কষ্ট হতো।
তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এল। এক সকালে ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে শহরে চলে গেল। সেই সকালে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। সেই সকালটি আমার কাছে ছিল ফড়িং ধরার মত। সেই সকালটি আমার কাছে ছিল রংধনুর মত। আমি দেঁৗড়ে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আমরা রেল লাইন ধরে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ বাবা একটি পুকুরের ধারে আমাকে নিয়ে বসে পড়লেন। আমাদের পিছন দিক দিয়ে ঝিক ঝিক শব্দে একটি ট্রেন চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পর সব নীরব হয়ে গলে।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, বেটা, তুই বাড়ি যা। আমি যাবনা।
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা বললেন, আমিতো এখনও মাথা ব্যথায় রাতে চিৎকার করি। টাকা পয়সাও নেই যে চিকিৎসা করাবো। তুই যখন বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবি তখনতো তোর বউও চিৎকারের জ্বালায় রাতে ঘুমাতে পারবে না। তখনতো আমাকে আবারো বাড়ি ছাড়তে হবে। তারচেয়ে আমি বাড়িতে নাইবা গেলাম। কি বলিস?
বাবার কথায় আমার বুকটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ঝাপসা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম তার চোখেও জল।
সেই সকালে আমাদের দু'জনের চারটি চোখ চারটি নোনা জলের পুকুর হয়ে গিয়েছিল।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪